অভিমান
– রাখী চক্রবর্তী
চরিত্র-মনিকা ও ওর বাবা-মা
রাজ ও রাজের মা
প্রথম দৃশ্য
(মঞ্চের পর্দা উঠল। মঞ্চের ওপর লাল আলো পড়েছে। ঘড়িতে রাত এগারোটা,
মনিকা বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছে)
মা -চুপিচুপি কাঁদতে নেই রে।আমাকে বল? কোথায় কষ্ট হচ্ছে মা বল। আমাকে বল। আমি যে তোর মা..
(মনিকা উঠে বসলো)
মাথায় হাত দিয়ে বসে ভাবলো, মা কোথা থেকে এল? আমি তো মাকে না বলে চিরকালের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।অসহ্য লাগছিল মাকে। দিনের পর দিন একই নাটক,পাগলামি, কতদিন সহ্য করবো! আফটার অল আমিও একজন রক্ত মাংসের মানুষ। শখ আহ্লাদ সব আছে আমার।
মৃত ছেলেকে নিয়ে তার এত ভাবনা, জীবিত মেয়ের প্রতি তার কোনও দায় নেই। তাই আমিও ভাববো না তার কথা। সেই ছোট্ট থেকে হাসির পাত্রী হয়ে বেঁচে আছি, আর না। স্কুলে যেতাম বন্ধুরা বলতো তোর মা একটুও তোকে ভালবাসে না। শুধু বিতান বিতান করে। তোর দাদা মরেও তোকে ভালোবাসা পেতে দেবে না। কপাল দেখ তোর দাদার। ছবিও কত আদর পায়, আর তুই, মাথা নিচু করে ওদের সব কথা শুনতাম, ছোট তো আমিও ছিলাম, তারপর সকাল সন্ধ্যায় যখন তখন রাস্তায় বেরিয়ে পড়তো মা,ছোট ছোট ছেলেগুলো ইট ছুঁড়ে মারতো মাকে, আমার বাচ্চা মন কি করে এত কিছু সহ্য করতো তা আমিই জানি, তাই মনটা আমার গুমরে থাকত সব সময়। কলেজে পড়ার সময়-ও মা ওই একই কাজ করতো।
দাদার টিফিন, ব্যাগ সব নিয়ে আমার কলেজে হাজির হয়ে যেত। নতুন নতুন বন্ধু- কতজনকে বলবো আমার মা পাগল, মানসিক ভারসাম্য হীন, বিতান ছাড়া কিছু জানে না সে, আমি মেয়ে হয়েও কেউ না মা’র, তোরা কিছু মনে করিস না। অনেক ডাক্তারকে দেখিয়েছে বাবা। সব ডাক্তারদের এক মত পুত্র সন্তান জন্ম দিলেই মার পাগলামি সেরে যাবে। কেন ডাক্তাররা বললো না, মেয়েকেই ছেলে ভাবুন মনিকাই আপনার ছেলের মতো কাজ করবে। বৃদ্ধ বয়সে ওই দেখবে আপনাকে। না, এসব ফালতু কথা ওনাদের কাছে। তাই আমি গত পরশু দিন বাবা মা’কে কিছু না বলেই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। মুম্বাইতে পেয়িং গেস্ট হয়ে আছি। চাকরি পেয়েছি ভালো কোম্পানিতে। কোম্পানির মালিক আমার থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন। বাঁচবো.. প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেবো। কোনো দুঃখকে কাছে ঘেঁষতে দেব না। আমি একা–একাই বাঁচবো।
বিছানা থেকে নেমে টিউব লাইটটা জ্বালালো মনিকা। এক গ্লাস জল খেল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো করে দেখছে মনিকা।
(স্বগোতক্তি)
হ্যাঁ, কপালে মা হাত দিয়েছে। গালটাও ধরলো। চোখের কোনে জলটা এখনও আছে। কিন্তু আমি কাদঁছিলাম কেন! আমি তো স্ব-ইচ্ছায় এই ডিসিশনটা নিয়েছি। আর মা তো আমার জন্য কোনদিন চোখের জল ফেলেনি। আদরও করেনি, ক্লাস এইটে পড়ার সময় একদিন আমি রিক্সা থেকে পড়ে গেছিলাম। পাড়ার ছেলেরা আমাকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে এল। মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো, বিতানের খুব লেগেছে না। আহারে, ছেলে আমার কত কষ্ট পেয়েছে বলেই দাদার ছবিতে হাত বুলাতে লাগলো।
আমি চিত্কার করে কেঁদে বললাম, মা আমার লেগেছে আমার। একটু আদর করো মা আমাকে। মা আমার কোনও কথা শোনেনি সেদিন। আজ এত বছর পর, সব ফালতু-স্বপ্ন, ইমোশন।
মনিকা বিছানায় শুতে চলে গেল।
(দ্বিতীয় দৃশ্য )
মনিকা সকাল দশটায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা
করে শপিং করতে যাবে এমন সময় বস্ রাজ রায় এসে হাজির।
হুকুম দিলেন বস্ ওনার সাথে যেতে হবে।
রাজ – চলুন একবার আমার সাথে বেরোতে হবে।
{স্বগোতক্তি- অগত্যা কিছু করার নেই। চাকরিটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে তো।}
মনিকা সেজেগুজে বস্এর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। রেস্তারাঁয় খাওয়া হল। শপিংও করলো টুকটাক। এবার অনুরোধ করলেন,
রাজ- কাছেই আমার বাড়ি একটু ঘুরে আসবেন চলুন।
মনিকা আমতা আমতা করেও চললো বস্ এর বাড়িতে। রাজ রায় মানুষটা কি চায়। ভাবতে ভাবতে রাজ রায়ের বাড়িতে পৌছে গেল মনিকা।
দরজা বরাবর বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে বছর পঞ্চাশের এক মহিলা পরিচয় করিয়ে বললেন,
রাজ- ইনি আমার মা।
(বস্ এর মার দিকে তাকিয়ে)
মণিকা- স্যার আপনি যে বলছিলেন আপনার বাবা নেই। তাহলে শাঁখা সিঁদুর.. আপনার মা…
রাজ -আমার বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়, আমি তখন দশ বছরের। বাবার ডেড বডি দেখে মা অজ্ঞান হয়ে যায়। চারদিন পর জ্ঞান ফিরল মা’র। কিন্তু মা তখন থেকে জানে বাবা বেঁচে আছে। বাবার মঙ্গল কামনায় রোজ সিঁদুর পড়ে মা। মার মাথা খারাপ হয়ে গেছে তাই বলে আমি হাল ছাড়িনি। ভালবাসার পরশ দিয়ে মাকে আগলে রেখেছি। সবাই বলে আমার মা পাগল তবে এখনও আশা রাখি মা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। মায়ের আদর পেলাম না। সেই যে দশ বছর বয়সে যা পেয়েছি তাই নিয়ে আজও হাসিমুখে মার যত্ন করি। একদিন মা ঠিক আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবে, “আয় বাবা খেয়ে নে”।
(মনিকার দু’চোখ জলে ভরে গেল। রাজের প্রতিটা কথা তীরের মতো বিধছে ওর বুকে,
অভিমান করে মার কাছ থেকে দুরে দুরে থেকে গেছি। একবারও ভালবেসে মাকে জড়িয়ে ধরিনি। কেন কেন!
মনিকা মাথা নিচু করে ভাবলো মাকে বঞ্চিত করেছে ও। একটু ভালবাসার হাত যদি মা’র মাথায় বুলিয়ে দিত তাহলে মাও নিশ্চয়ই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসত। মানসিক ভারসাম্যহীনতা বা পাগলামি সব তো ভালবাসা দিয়ে সারিয়ে তুলতে হয়, এই ছোট কথা বুঝতে আমার এতো দেরি হলো,
মনিকা বিড়বিড় করে বললো, এখনও সময় আছে যা ছুটে যা ।)
মণিকা- স্যার আজ আমি যাই। অন্য একদিন আসবো। আন্টিকে প্রণাম জানাই। দেখবেন আন্টি ঠিক ভালো হয়ে যাবে।
রাজ- মিস মনিকা কালই জয়েনিং ডেট। মনে আছে তো।
মনিকা- স্যরি স্যার, আজকের ফ্লাইটে কলকাতায় যেতে হবে আমাকে।
রাজ -এনি প্রবলেম?
মণিকা- স্যার,আমার মাকে সারিয়ে তুলতে হবে। বাই স্যার..টেক কেয়ার।
তৃতীয় দৃশ্য
(মঞ্চ আলোয় আলোকিত)
{রাজ রায় ওর মাকে জড়িয়ে ধরে}
রাজ- ব্যাস..এইটুকুইতেই শান্তি তাই না মা?
মা দেখো মিস মনিকার মা এবার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।
রাজের মা- হ্যাঁ রে, মনিকা ভেতর থেকে একা রে। ভগবান ওর সহায় হোক।
মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের খুব কষ্ট রে।
রাজ- হ্যাঁ মা,মনিকার সমস্ত ঘটনা শুনলাম কোলকাতার দীপকের মুখে, মনে আছে তো দীপককে তোমার?
রাজের মা- হ্যাঁ রে, মনে নেই আবার, তোর কলকাতার ব্যবসা পত্র তো ঐ দেখে।
রাজ- তারপরই আমাদের নাটক জমে ক্ষীর হয়ে গেল মা হা হা হা..
রাজের মা -আমার সোনা ছেলে,উমমমা..
চতুর্থ দৃশ্য
{মনিকা বাড়ি ফিরে দেখল ওর মা বিতানের ছবিতে ভাত খাওয়াচ্ছে। আর ওর বাবা মাথায় হাত দিয়ে বারান্দায় বসে আছে।
মনিকা বাবার দিকে এগিয়ে এসে হাত ধরে)
মণিকা- বড় ভুল করেছি বাবা, আর না.. বলেই মনিকা ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ওমা আমাকে খাইয়ে দাও। যেমন করে দাদাকে খাইয়ে দিচ্ছ।
মণিকার মা -তোকে খাইয়ে দেব? কিন্তু ওর যে এখনও খেতে অনেক সময় লাগবে,
মণিকা -হ্যাঁ মা, দুই ছেলে মেয়েকে একসাথে খাওয়ায় আজ, কতদিন খাইনি তোমার হাতে ভাত মাখা।
মণিকার মা -চোখে জল কেন তোর!
মণিকা – তুমি তো আমাকে ভালবাসো না..
মণিকার মা -পাগল মেয়ে দাদা যে কতদিন না খেয়ে আছে সেটা ভাব।
{স্বগোতক্তি: মণিকা মা’র করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিজ্ঞা করলো, তোমাকে কেউ আর পাগলি বলে ক্ষেপাবে না মা। আমি তোমাকে সারিয়ে তুলবো। মনিকা ওর ডান হাত মা’র হাতে দিয়ে বললো}
মণিকা- এটা বিতান আর বাম হাত দিয়ে বললো, এটা মনি। তোমার দুই সন্তান ভালবাসা পাবে আজ থেকে।
শেষ দৃশ্য
{মণিকা গান শুরু করলো, মাকে জড়িয়ে}
“তোমার সুখ যে আমার সুখ মা
বুঝিনি তো আগে
দুরে গিয়ে পেলাম ফিরে
আমার সোনা মাকে
তোমার এক চোখেতে দাদার বাস
অন্য চেখে আমি
তোমার নিশ্বাসে আমি বাঁচি
মাগো তোমায় পেয়ে ধন্য আমি”।
(এক এক করে সব আলো জ্বলে উঠলো মঞ্চে)
মণিকার এক কাঁধে ওর বাবার মাথা আর অন্য কাঁধে ওর মার মাথা, নতুন জীবন ফিরে পেল মণিকার মা বাবা এবং মণিকা নিজে।